গত বছরের প্রথমার্ধের পুরোটাই ছিল পিএসসির প্রশ্নফাঁস কেলেঙ্কারির নানা কাহিনীতে সরগরম। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)সহ একাধিক সংস্থার তদন্তে বেরিয়ে আসে, ২৪ বছর ধরেই সক্রিয় এসব চক্র বিসিএস ও নন-ক্যাডারের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছিল একের পর এক। প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে শুধু প্রশাসন ক্যাডারেই নিয়োগ পেয়েছে শত শত কর্মকর্তা। এসব প্রশ্নফাঁস চক্রের মূল হোতা হিসেবে যার নাম বেরিয়ে আসে তিনি হলেন পিএসসির গাড়িচালক আবেদ আলী। সেই থেকে প্রশ্নফাঁসের ঘটনাকে প্রতীকী অর্থে “আবেদ আলী কোটা” বলা হয়ে থাকে। আবেদ আলী কোটায় নিয়োগ পাওয়া এক নারী কর্মকর্তাই নতুন জনপ্রশাসন সচিব হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন। এ ব্যপারে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে গ্রিন সিগন্যালও নাকি দেIয়া হয়েছে। ফলে এ নিয়ে প্রশাসনে নতুন করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
ভাগ্যবান এই নারী কর্মকর্তা হলেন প্রশাসন ক্যাডারের ১৫তম ব্যাচের সদস্য। তিনি এবং তাঁর ভাই- উভয়েই এই ব্যাচে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন। ভাই-বোন একই সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়ার পেছনে রয়েছে প্রশ্নফাঁসের এক বড় কাহিনী। সরকারি সংস্থার অনুসন্ধানেই এ তথ্য বেরিয়ে আসে।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, পিএসসির একজন সাবেক মেম্বার তার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন এই শর্তে যে, বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করে দিবো, তবে আমার মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। শ্বশুর ছিলেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কমিটির সভাপতি। শুধু মেয়ের জামাই নয়, জামাইয়ের বোনকেও একই কায়দায় বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করা হয়েছে। ১৯৯৫ সালে ১৫তম বিসিএস পরীক্ষায় জামাই ও তার বোনকে উত্তীর্ণ করেছেন ফাঁস করা প্রশ্নের মাধ্যমে। জামাইও তার কথা রেখেছেন, উত্তীর্ণ হওয়ার পর পিএসসির তৎকালীন ওই মেম্বারের মেয়েকে বিয়ে করেছেন। এক পরিবারের ভাই-বোন এখন সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তা। বোন বাংলাদেশ সচিবালয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগের সচিব পদে কর্মরত, আর ভাই সড়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে যখন পিএসসির প্রশ্নফাঁস নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড চলছিল ওই সময়ই বেরিয়ে আসে এই ভাই-বোনের একই সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়ার রহস্য। গণমাধ্যমে এ নিয়ে খবরও প্রকাশিত হয়।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ৯ অক্টোবর, ২০২৪ এই নারী কর্মকর্তা সচিব পদে নিয়োগ পেয়েছেন। এই এক বছরে তিনি সচিব পদে ন্যূনতম সাফল্যও দেখাতে পারেননি। বরং অধীনস্থ কর্মকর্তারা তাকে সচিব হিসেবে চরমভাবে ব্যর্থ বলেই আখ্যায়িত করে থাকেন। এমনকি এও বলা হয়ে থাকে, “তিনি সচিব নন। উপদেষ্টার এপিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।” এই নারী সচিবের আলোচিত ছেলে মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানসমুহে তদবির বাণিজ্যে লিপ্ত রয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে।
উল্লেখ্য, ঘুষ-দুর্নীতিসহ নানা রকমের অসংখ্য অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ সেপ্টেম্বর মোখলেস উর রহমানকে জনপ্রশাসন সচিবের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। সেই থেকে এ পদটি শূন্য রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার জাতিসংঘ সম্মেলনে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে বর্ধিত সফরে থাকার কারণেই সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রণালয়টি এতোদিন চালকবিহীন এবং কর্মবিহীন অবস্থায় থাকে।
পূজার ছুটি শেষে গত ৫ অক্টোবর সরকারি কর্মদিবসের প্রথম দিনে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমদকে নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় বসেন বেলা ১১ টায়। প্রধান উপদেষ্টা বর্তমান চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্য হতে অপেক্ষাকৃত নরম প্রকৃতির একজনকে জনপ্রশাসন সচিব হিসাবে নিয়োগের নির্দেশনা দেন। ওইদিনই অপরাহ্নে এ সংক্রান্তে একটি সারসংক্ষেপ পাঠানো হয় প্রধান উপদেষ্টার দফতরে। কিন্তু জামায়াতের বাধার কারণে প্রধান উপদেষ্টার সেই নির্দেশ কার্যকর হতে পারেন। যদিও প্রস্তাবিত নরম প্রকৃতির এই কর্মকর্তা মোটেই বিএনপির নন, তারপরও জামায়াত এই নিয়োগে বাধা দেয়। জামায়াতের পক্ষ থেকে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদের নেতৃত্বে একটি টিম ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়াটি বাতিল করে দেয়। তাদের চাহিদা হলো, একজন কট্টর জামায়াত সমর্থক কর্মকর্তাকে জনপ্রশাসন সচিব পদে বসানো। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনের নামও তারা উপস্থাপন করেছেন। অবশেষে এসেছে এই নারী কর্মকর্তার নাম।