অবৈধ পাসপোর্টে যাতায়াত, একাধিক বিয়ে ও প্রতারণার অভিযোগে আলোচনায় কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা তরুণী
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া এক রোহিঙ্গা পরিবারের মেয়ে তৈয়বা আক্তার। কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম তার। কিন্তু তিনি আজ পরিচিত— ‘রোহিঙ্গা সুন্দরী মালয়েশিয়ান তৈয়বা’ নামে। অবৈধভাবে অর্জিত বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে তিনি মালয়েশিয়ায় নিয়মিত যাতায়াত করছেন, যেখানে তার রয়েছে একাধিক স্বামী। পাশাপাশি বিয়ের প্রলোভনে বহু রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি যুবককে নিঃস্ব করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
কে এই তৈয়বা?
তৈয়বার প্রকৃত পরিচয় মেলে তার রোহিঙ্গা এমআরসি কার্ড থেকে। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বি-ব্লকের ৪১নং শেডের বাসিন্দা তৈয়বা আক্তারের জন্ম ১৯৯৪ সালের ১ জানুয়ারি। কার্ডে তার মা সুরুজ জামান ও ভাই নুরুল আফসারসহ পরিবারের আরও ৫ সদস্যের নাম রয়েছে।
তৈয়বা প্রথমে এক রোহিঙ্গা যুবকের মাধ্যমে ৬ বছর আগে মালয়েশিয়া যান। এরপর তার সঙ্গে বিচ্ছেদ হলে তিনি একে একে অন্তত ৬টি বিয়ে করেন এবং আরও অনেকের কাছ থেকে বিয়ের আশ্বাসে টাকা হাতিয়ে নেন।
অবৈধ পাসপোর্ট ও মিথ্যা পরিচয়
তৈয়বা বর্তমানে বাংলাদেশি পাসপোর্ট (নম্বর: EM0189…) ব্যবহার করছেন, যা ২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর ইস্যু হয়। এতে তার ঠিকানা দেওয়া হয়েছে নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার চন্দ্রসুদ্দি গ্রামে, বাবার নাম বাবুল মিয়া, মায়ের নাম আমেনা খাতুন এবং স্বামী হিসেবে উল্লেখ রয়েছে দাদন মিয়ার নাম।
তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই পরিচয় সম্পূর্ণ মিথ্যা। তৈয়বার পাসপোর্টের ছবি ও রোহিঙ্গা কার্ডের ছবির সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে। এমনকি তার আরও একটি পুরোনো পাসপোর্টের স্ক্যান কপিও পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের পাসপোর্ট আইনে শুধু নাগরিকরাই পাসপোর্ট পেতে পারেন। ভুয়া তথ্য দিয়ে পাসপোর্ট নেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যার সাজা সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড বা জরিমানা, অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
প্রতারণার শিকার যুবকদের কাহিনি
রোহিঙ্গা তরুণ মোহাম্মদ আতিক জানান, প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তৈয়বা তার কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন মালয়েশিয়ায় বিয়ে ও নতুন জীবন গড়ার আশ্বাস দিয়ে। পরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে আতিক বলেন, “আমি তাকে বিশ্বাস করে সব দিয়েছি, এখন আমি নিঃস্ব।”
একইভাবে রোহিঙ্গা যুবক সালামত উল্লাহর সঙ্গে বিয়ের পর তিনি তার ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। কানাডা প্রবাসী রহিমউল্লাহকে বিয়ের নামে মালয়েশিয়ায় ডেকে এনে ব্ল্যাকমেইল করে বিপুল অর্থ আদায় করেছেন তৈয়বা। এক পাকিস্তানিকেও একইভাবে প্রতারণা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া মেহেদী নামের এক বাংলাদেশি তরুণও তার দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
মালয়েশিয়ায় চলমান বিয়ে বাণিজ্য
তৈয়বার প্রতারণার ধরন প্রায় একই— প্রেম, বিয়ে, টাকা আদায় এবং পরে সম্পর্ক ছিন্ন। মালয়েশিয়ায় স্থান পরিবর্তন করে গা-ঢাকা দিয়ে তিনি এসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান স্থানীয় এক ব্যবসায়ী।
ধরা পড়ে অনেকে, অথচ তৈয়বা অধরা
অনেক রোহিঙ্গা নারী পাসপোর্ট করতে গিয়ে ধরা পড়লেও তৈয়বার মতো অবৈধ পাসপোর্টধারীরা রয়ে যাচ্ছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
পাসপোর্ট অফিস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, এখনকার প্রক্রিয়া অনেক কঠিন হলেও আগে দালালদের মাধ্যমে অনেক রোহিঙ্গা পাসপোর্ট পেয়েছেন। তারা এসব ভুয়া পাসপোর্ট বাতিল ও জড়িতদের শাস্তির দাবি তুলেছেন।
পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোবারক হোসেন জানান, “অবৈধভাবে কেউ পাসপোর্ট পেলে তথ্য-প্রমাণ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রশ্ন রয়ে যায়
তৈয়বার মতো একজন রোহিঙ্গা নারী কিভাবে একাধিক পাসপোর্ট তৈরি করে, বছরের পর বছর ধরে দেশ-বিদেশে যাতায়াত করে, আর প্রতারণা করেও অধরা থাকেন? এটা কি শুধু দালাল চক্রের কাজ, না কি এর পেছনে রয়েছে বড় কোনো চক্র বা দুর্নীতিবান্ধব কাঠামো?
এই ঘটনায় সরকার, ইমিগ্রেশন বিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর আরও দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক ভূমিকা এখন সময়ের দাবি।