কার নির্দেশে খসড়া না দেখেই ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) চুক্তিটি সই করেছিল তাকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে রাজসাক্ষীর ওপর নির্ভর করে চাপ দিয়ে আদানিকে আলোচনার টেবিলে আনার চেষ্টা করা হবে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আদালতে যাবে বাংলাদেশ। এছাড়া সরকারের গঠিত পর্যালোচনা কমিটি চুক্তির বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখছে।
সূত্রমতে, গত বছর বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর আগেই আদানির কেন্দ্রটির কয়লার দাম নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়। সে সময় কয়লার চড়া দাম দিতে অস্বীকৃতি জানায় পিডিবি। এতে কয়লার দাম কমাতে রাজি হয় আদানি। পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানিকৃত কয়লার মধ্যে সর্বোচ্চ দামের চেয়ে শূন্য দশমিক শূন্য এক সেন্ট (০.০১) কম দাম রাখার প্রস্তাব করে আদানি। এক বছরের জন্য এ দাম রাখার কথা বলা হয়েছিল। তাই বর্তমানে আবারও কয়লার বাড়তি দাম চাইছে আদানি।
যদিও পিডিবি কয়লার দাম কমাতে আদানিকে কয়েক দফা চিঠি দিয়েছে। তবে তারা আলোচনায় বসতে রাজি হচ্ছে না। পিডিবি সূত্র বলছে, পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিত এক হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতি টন কয়লার দাম নিচ্ছে ৭৫ মার্কিন ডলার। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এসএস পাওয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি টন কয়লার দাম ৮০ ডলারের কম। আর আদানি প্রতি টন কয়লার দাম চাইছে ৯৬ ডলার। তার মানে প্রতি টন কয়লায় রামপাল ও পায়রার ১৬ ও ২১ ডলার বাড়তি চাইছে তারা।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান শেয়ার বিজকে বলেন, আদানি বিল জমা দিলেই হবে না। বাড়তি দাম দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কয়লার বাড়তি দামের বিষয়টি পিডিবি দেখবে। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে পেশাদারির সঙ্গে নিরপেক্ষতা বজায় রেখেই চুক্তির বিষয়গুলো দেখা হবে। এরই মধ্যে চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে।
যদিও চুক্তিতেই নানা ধরনের বাড়তি সুবিধা দেয়া হয়েছে আদানিকে। সাধারণত কয়লা কেনার সময় সমঝোতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক বাজারে ছাড় পাওয়া যায়। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লা কেনে বিশেষ ছাড়ে। তবে আদানির সঙ্গে পিডিবির চুক্তিতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার সূচকের (কোল ইনডেক্স) গড় মূল্য হিসাব করা হবে। গড় দাম ধরার কারণে আদানির বিলে বাড়তি দাম আসছে। এছাড়া আদানি বিশেষ ছাড়ে কয়লা কিনলেও সেই সুবিধা পাবে না পিডিবি।
তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক দুই সূচকে বিভিন্ন মানের (ক্যালেরিফিক ভ্যালু) কয়লার দাম প্রকাশ করা হয়। সূচকে বিভিন্ন মানের কয়লার ভিন্ন ভিন্ন দাম হয়ে থাকে। আদানি উন্নতমানের (ছয় হাজার ৫০০ ক্যালেরিফিক ভ্যালু) কয়লার দাম ধরে তার ভিত্তিতে বিল করছে। যদিও তারা পাঁচ হাজার ৮০০ ক্যালেরিফিক ভ্যালুর (তুলনামূলক নিম্নমানের) কয়লা ব্যবহার করছে। সে হিসাব করা হলে প্রতি টনে কয়লার দাম ২০ থেকে ২৫ ডলার কমে যাবে। এ বিষয়ে পিডিবি এক কর্মকর্তা ইলিশের উদাহরণ টেনে বলেন, বাজারে এক কেজি আকারের ইলিশের দাম দুই হাজার টাকা; আর ৭০০ গ্রাম আকারের ইলিশের দাম ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা; কিন্তু এক কেজি আকারের বাজারদর ধরে ৭০০ গ্রামের মাছের দাম হিসাব করা হলে এটি হবে এক হাজার ৪০০ টাকা। কয়লার ক্ষেত্রে এমনটাই করছে আদানি।
চুক্তিতে আদানিকে দেয়া বাড়তি সুবিধা এখানেই শেষ নয়। বিল জমা দেয়ার পর দেরিতে পরিশোধের জন্য বছরে ১৫ শতাংশের সুদ ধরা আছে আদানির চুক্তিতে, যা পায়রা বা রামপালে নেই। এতে পিডিবি বকেয়া বিল পরিশোধ করলেই চুক্তির শর্তানুসারে তা থেকে বকেয়া বিলের সুদ কেটে তারপর বিদ্যুৎ বিল সমন্বয় করে আদানি। ফলে বকেয়া বিল বেড়ে যাচ্ছে। আদানিকে চুক্তিতে আরও বেশকিছু বাড়তি সুবিধা দেয়া হয়েছে, যা দেশের অন্য কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র পাচ্ছে না। এর মধ্যে অন্যতম হলো ন্যূনতম বিদ্যুৎ কেনা। এ বিষয়ে চুক্তির ৩.১-এর (বি) ধারায় বলা হয়েছে, পিডিবিকে প্রত্যেক বছর কেন্দ্রটির বিদ্যমান সক্ষমতার কমপক্ষে ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনতে হবে, যা ‘মিনিমাম অফটেক কমিটমেন্ট’ হিসেবে বিবেচ্য হবে। যদি বাংলাদেশ তা কিনতে ব্যর্থ হয় তাহলে পিডিবির পক্ষ থেকে আদানি পাওয়ারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এ ক্ষতিপূরণের মধ্যে থাকবে কয়লার দাম, কয়লা পরিবহন ব্যয়, বন্দরে কয়লার খালাস ব্যয় ও কয়লার হ্যান্ডলিং ব্যয়।
পায়রা ও রামপালের বিদ্যুৎ নেয়ার জন্য এমন কোনো ন্যূনতম সীমা নেই। এ দুটির সঙ্গে আদানির চুক্তিও আরেকটি পার্থক্য হলো, পায়রা ও রামপাল চুক্তিতে হরতাল, যুদ্ধ বা আইন পরিবর্তনের মতো রাজনৈতিক ঘটনাকে ‘ফোর্স মেজার’ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ এ সময় কোনো কিছু ঘটলে উভয় পক্ষই একে অপরের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি পাবে। কিন্তু আদানি পাওয়ারের সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, এমন কোনো ঘটনায় বাংলাদেশ যদি বিদ্যুৎ না কিনতে পারে, তবে ক্যাপাসিটি চার্জ ও জরিমানাসহ সব ধরনের পাওনা তাদের দিতেই হবে। কিন্তু একই কারণে যদি আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারে, তবে পিডিবিকে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ দিতে তারা বাধ্য নয়।
চুক্তির আরেকটি অযৌক্তিক ধারা হলো, যদি রাজনৈতিক কোনো কারণে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেটা মেরামত ও এ সংশ্লিষ্ট সব ব্যয় পিডিবিকে দিতে হবে। রামপাল বা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে এই সম্পূরক খরচ দিতে হবে না। আদানির জন্য আরেকটি সুবিধাজনক ধারা হলো, গ্রিডে মোট বিদ্যুৎ সরবরাহ করার নির্ভরযোগ্য সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য প্রথমবারের পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করতে পারার সুযোগ।
মানসম্পন্ন চুক্তিতে এ পরীক্ষা একবারই করা হয় এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে তাকে জরিমানা দিতে হয়। গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে আদানি পাওয়ার নিজস্ব খরচে আরেকটি পরীক্ষা করতে পারবে। নতুন পরীক্ষায় যদি প্রত্যাশিত রিডিং পাওয়া যায়, তবে তারা আগে পিডিবিকে দেয়া ক্ষতিপূরণের টাকাও ফেরত নিতে পারবে। চুক্তির শর্তানুসারে, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বাড়তি সুবিধা এখানেই শেষ নয়। যদি আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ দিতে প্রস্তুত থাকে, তবে কোনো কারণে চাহিদা দিয়েও সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ না কিনলে আমদানিকৃত কয়লার মূল্য পিডিবিকে পরিশোধ করতে হবে। তবে কয়লার দাম দিলেও এর মালিকানা পিডিবি পাবে কি না, তা চুক্তিতে বলা হয়নি। প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বেসরকারি খাতে ৯১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হলেও, সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয় আদানির সঙ্গে সই করা চুক্তিটি। ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার জন্য ২৫ বছরের চুক্তি করে বাংলাদেশ। চুক্তি সইয়ের সময় বৈঠকে উপস্থিত তিনজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজের কাছে এ বিষয়ে বিস্তারিত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, আদানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিতে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা অনুসরণ করা হয়। চুক্তির খসড়া বিদ্যুৎ বিভাগে এলেও তা পিডিবিতে পাঠানো হয়নি। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া নিয়ে কাজ করা পিডিবির কর্মকর্তারা চুক্তির বিষয়ে আগে থেকে কিছুই জানতেন না। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ শেষদিকে এসে চুক্তির কপি পায় পিডিবি।
তারা আরও জানান, তৎকালীন বিদ্যুৎ সচিব আহমদ কায়কাউসের সরাসরি তত্ত্বাবধানে চুক্তি সই হয়। তিনি আদানির সঙ্গে মিটিংয়ে ঢুকার আগেই পিডিবির কর্মকর্তাদের সতর্ক করেন, যেন চুক্তি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা না হয়। এভাবে দরকষাকষি ছাড়াই আদানির সঙ্গে চুক্তি সই হয়। এছাড়া আদানির সঙ্গে চুক্তি দ্রুত সম্পাদনের জন্য তৎকালীন মুখ্য সচিব ও সাবেক বিদ্যুৎ সচিব মো. আবুল কালাম আজাদ বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি দেন। তাই রাজসাক্ষী হিসেবে স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য ওই দুই সচিবের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তৎকালীন দুই সচিবের একজনকে ধরতে পারলেই এ বিষয়ে স্বীকারোক্তি নেয়া যাবে। তখন আদানিকে চাপ দিয়ে আলোচনার টেবিলে আনা যাবে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলাও করা যাবে।
জানতে চাইলে চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির সদস্য ও বুয়েটের অধ্যাপক আবদুল হাসিব চৌধুরী বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশেই এমনটি হয়ে থাকে। সাধারণত সরকার পতনের পর তাদের দুর্নীতি খোঁজা শুরু হলে সংশ্লিষ্ট অনেকেই তথ্য দিতে এগিয়ে আসেন। আমরাও সে দরজা খোলা রেখেছি।’ এদিকে গড্ডার বিদ্যুৎকেন্দ্রের এলাকাকে ভারত সরকার ‘এসইজেড’ (বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল) ঘোষণা দেয় ২০১৯ সালে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে সব ধরনের শুল্ক-কর ছাড় পাচ্ছে আদানি। তা বিবেচনায় নিলে কমবে ক্যাপাসিটি চার্জ ও কয়লা আমদানি ব্যয়। চুক্তির ১৩.১-এর (ই) ধারায় বলা হয়েছে, আদানি পাওয়ার অ্যাজাম্পশনগুলো (ট্যাক্স ও ভ্যাটের হার) কোনো পরিবর্তন হলে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে পিডিবিকে জানাতে হবে। তবে তা করেনি আদানি। এর মাধ্যমে বাড়তি ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় ও কয়লার দাম নিয়ে প্রতারণা করছে কোম্পানিটি।
সূত্র : শেয়ার বিজ