সার্বিয়া পেরিয়ে অভিবাসীদের বসনিয়ায় আসার পথে বড় বাধা দ্রিনা নদী৷ স্থানীয়রা কেউ মানবিক কারণে অভিবাসীদের দিকে সহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন৷ কেউ টাকা রোজগারের সুযোগ খোঁজেন৷ বলকান রুটের এই অংশের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন ডিডাব্লিউর একজন সাংবাদিক৷
বসনিয়া-হ্যারৎসেগোভিনায় দ্রিনা নদীর কাছের একটি গ্রাম কজলুক৷ গ্রীষ্ম শেষের রৌদ্রজ্জ্বল এক দিন৷ নদীর গভীরতা এখানে কোনো কোনো জায়গায় দেড় মিটার বা পাঁচ ফুট প্রায়৷ কোথাও আবার হাঁটু সমান৷ যেমন এখানটায় এক তীর থেকে অন্য তীরে হেঁটেই পার হওয়া যায়৷
নদী পেরিয়ে তীরে উঠলেন তিনজন৷ তাদের শর্টস আর টি-শার্ট তখনও ভেজা৷ একজনের নাম আমান৷ বয়স ২০ বছর৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বললেন, ‘‘আমরা ওই তীরে কাউকে দেখিনি, তাই রওনা দিয়েছি৷ নদীর কোনো কোনো জায়গা পুরোপুরি শুকনো৷ ভিজে গেছি, কিন্তু রোদ আছে৷ কাজেই দ্রুত শুকিয়ে যাবে৷’’ তার কথার পর তিন জনই হাসলেন৷
তিন জনই এসেছেন উত্তর আফ্রিকার দেশ মরক্কো থেকে৷ গন্তব্য পশ্চিম ইউরোপে৷ শুরুতে তারা তুরস্ক থেকে গ্রিস হয়ে এসছেন নর্থ মেসিডোনিয়াতে৷ সেখান থেকে সার্বিয়া৷ কয়েকদিন তারা কাটিয়েছেন দেশটির রাজধানি বেলগ্রেদের এক আশ্রয় শিবিরে৷
ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশী এশিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে বলকান রুট দীর্ঘদিন ধরেই পরিচিত৷ দ্রিনা নদী এই পথেরই অংশ৷ যাত্রার শুরু তুরস্ক থেকে৷ সেখান থেকে গ্রিস বা বুলগেরিয়া হয়ে অভিবাসীরা বলকান অঞ্চলে প্রবেশ করে।
সার্বিয়া এবং বসনিয়া ও হ্যারৎসেগোভিনার সীমান্তের বড় একটি অংশজুড়ে দ্রিনা নদীর অবস্থান৷ মরক্কোর সেই তিন অভিবাসী সার্বিয়া সীমান্তে নদীর তীরে দীর্ঘ সময় সুযোগের অপেক্ষায় থেকেছেন৷
তাদের একজন নদী পার হতে গিয়ে পায়ে সামান্য আঘাত পেয়েছেন৷ বসনিয়ার রেড ক্রস দলের একজন হাঁটুর ক্ষত স্থানে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলেন৷ নদী পেরিয়ে আসা এমন অভিবাসীদের সেবা দেয়াই তাদের কাজ৷
নদী তীরে রেড ক্রসের দলটি নিয়মিত ঘুরে বেড়ায়৷ কোনো অভিবাসীর খাদ্য বা চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজন কিনা তার খোঁজ করে৷
তাদের দলনেতা ম্লাদেন মাইস্ত্রোভিচ জানালেন, পুলিশের সাথেও তাদের মাঝে মধ্যেই দেখা হয়৷
তার সহকর্মী দার্কে জোভানোভিচ৷ তিনি জানান, বছরের প্রথম আট মাসে অন্তত ৮০০ শরণার্থীকে সেবা এবং তিন বেলা খাবার দিয়েছেন তারা৷
নদীতে প্রাণহানি-
প্রতিদিনই অনেক অভিবাসী নদীর এই অংশটি পেরিয়ে বসনিয়ায় আসেন৷ তাদের বাধা দেয়া কঠিন৷ বসনিয়ার সীমান্তরক্ষীরা নিয়মিত টহল দিলেও সংখ্যায় তারা কম৷ গোটা এলাকাটি ঠিকঠাক পাহারা দিতে আরো কয়েক হাজার সেনা প্রয়োজন৷
বিভিন্ন সময়ে বলকান রুটকে অকার্যকর দাবি করা হলেও প্রকৃতপক্ষে অভিবাসী আসা কখনোই পুরোপুরি বন্ধ হয়নি৷ বরং সাম্প্রতিক সময়ে পথটি আবারও ব্যস্ত হতে শুরু করেছে, বিশেষ করে দ্রিনা নদীর তীর ধরে৷
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই পথে বিয়োগান্তক অনেক ঘটনাও ঘটেছে৷ সবশেষ ঘটনাটি কয়েক সপ্তাহ আগের৷ ২২ আগস্ট সার্বিয়ার শহর লিউবভাবিয়ার কাছে দ্রিনা নদীতে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত মানুষ নিয়ে যাত্রা করা একটি নৌকা ডুবে ১২ অভিবাসীর মৃত্যু হয়৷
মানবপাচারকারীরা নৌকায় ইচ্ছেমতো অভিবাসী তুলেছিল৷ তাদের মধ্যে ১৮ জনের প্রাণ রক্ষা পায়৷
‘সবকিছু সংগঠিত’
দ্রিনা নদী পেরিয়ে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি নিহাদ সুলজিকের চোখেও ধরা পড়েছে৷ বসনিয়ার পূর্বাঞ্চলে তুজলা শহরে তিনি চাকরি করেন৷ পাশাপাশি অভিবাসীদের সহায়তায় স্বেচ্ছাসেবীর দায়িত্বও পালন করেন ৩৪ বছর বয়সি এই মানবাধিকারকর্মী৷
প্রাণ হারানো অভিবাসীদের জন্য একটি সমাধি গড়ে তোলার কারণে সুলজিক এরইমধ্যে বসনিয়ায় সুপরিচিতি৷ ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, ‘অভিবাসনের প্রশ্নে বসনিয়া আবারও মনযোগের কেন্দ্রে৷ কিন্তু মহামারির বছরগুলো এবং তার আগের সময়কার চেয়ে মানবপাচারকারীরা এখন ব্যবস্থাটির সঙ্গে নিজেদের পুরোদস্তুর সংহত করে তুলেছে৷’
সুলজিক জানান, সীমান্ত পেরিয়ে আসার পর অভিবাসীরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে হেঁটে আশ্রয় শিবিরের দিকে যান৷ অনেকে আবার সরাসরি ক্রোয়েশিয়া সীমান্তের দিকেও রওনা দেন৷ তবে পথে ঘাটে তাদের দেখা তেমন পাওয়া যায় না৷ আশ্রয় শিবিরগুলোও প্রায় পরিপূর্ণ৷ সিলজিক বলেন, ‘‘দেখে মনে হচ্ছে সবকিছই যথেষ্ট সংগঠিতভাবে হচ্ছে৷’’
রাডিসিক দ্রিনা নদীর উপরে সার্বিয়ার সঙ্গে থাকা সেতুর উপরে দাঁড়িয়ে দেখাচ্ছিলেন কীভাবে অভিবাসীরা নীচ দিয়ে পার হয়৷ ছবি: দ্রাগান মাকসিমোভিচ/ডিডাব্লিউ
রাডিসিক দ্রিনা নদীর উপরে সার্বিয়ার সঙ্গে থাকা সেতুর উপরে দাঁড়িয়ে দেখাচ্ছিলেন কীভাবে অভিবাসীরা নীচ দিয়ে পার হয়৷ ছবি: দ্রাগান মাকসিমোভিচ/ডিডাব্লিউ
অভিবাসীদের রাখা হয় দৃষ্টিসীমার বাইরে
প্রায় একই অভিমত মিরোস্লাভ রাডিসিকেরও৷ বসনিয়া-সার্বিয়া সীমান্তের কাছে তার একটি অতিথিশালা আছে৷ তিনি জানান অভিবাসীকেন্দ্রিক ব্যবসা ক্রমশই এখানে বেড়ে চলেছে৷ আর পুরো ব্যাপারটিই একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পর্কিত এবং সবাই ভালোভাবেই অবগত৷
তিনি জানান, তার অতিথিশালার বাইরে ট্যাক্সিচালকেরা অপেক্ষায় থাকেন৷ অভিবাসীদের সঙ্গে তারা দরকষাকষি করেন৷ বলেন, ‘‘আপনি এখানে ঘুমাতে পারবেন না, সবসময় ট্যাক্সি আসা-যাওয়া করে৷’’ তার অভিযোগ, শরণার্থীদের নিয়ে ট্যাক্সি চালকেরা মারামারি করেন৷ কেননা কখনও কখনও ১০ জন শরণার্থীকে নেয়ার জন্য ২০ জন ট্যাক্সি চালকের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে৷
রাডিসিক দ্রিনা নদীর উপরে সার্বিয়ার সঙ্গে থাকা সেতুর উপরে দাঁড়িয়ে দেখাচ্ছিলেন কীভাবে অভিবাসীরা নীচ দিয়ে পার হয়৷ ‘তারা সেতুর নীচে স্টিলের গার্ডারে উঠে৷ আমাদের পাশে একটি দড়ি ফেলা আছে যেটি কেউ সরায় না, এমনকি পুলিশও না৷’
এর কারণ কী জিজ্ঞাসা করতেই রাডিসিক বলেন, সীমান্তে তখনই ঠিকঠাক টহল সম্ভব যদি পর্যাপ্ত সীমান্ত পুলিশ থাকে৷
বসনিয়া-হ্যারৎসেগোভিনার সীমান্ত পুলিশের কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিল ডিডাব্লিউ৷ তারা জানিয়েছে সীমান্তে তাদের সদস্যরা নিবিড় নজরদারি বজায় রেখেছে৷ আরো পুলিশ সদস্য ও বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে৷ অনিয়মিত অভিবাসন বন্ধ করা তাদের লক্ষ্য৷
এক বিবৃতিতে সীমান্ত পুলিশ জানিয়েছে, ‘বছরের শুরু থেকে সীমান্ত পুলিশ পাঁচ হাজার ৪৭৭ জনকে নিবন্ধন করেছে যারা অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করেছে বা করার চেষ্টা করেছে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানবপাচারকারীরা ব্যক্তিগত গাড়ি, অথবা নৌকায় করে দ্রিনা নদীর আশেপাশে মানুষ জড়ো করে৷’
প্রতিবেদনের শুরুতে বলা তিন মরক্কান অবশ্য তাদের যাত্রার বর্ণনায় কোনো মানবপাচারকারীর কথা উল্লেখ করেননি৷ আপাতত বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো যাওয়ার পরিকল্পনা তাদের৷ সেখান থেকে তারা যাবেন উত্তর পশ্চিম বসনিয়ায় বিহাচের কাছে ক্রোয়েশিয়া সীমান্তে৷ তাদের মূল লক্ষ্য জার্মানি৷
কেন এই ঝুঁকি নিচ্ছেন জানতে চাইলে তারা বললেন, মরক্কোতে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না৷ একটি ট্যাক্সিতে উঠে স্ভরনিকের দিকে রওনা করলেন তারা৷
সূত্র: ইনফো মাইগ্রেন্টস্ বাংলা