কেউ একজন বলেছিল, একটা শর্ত আছে, আপনি যদি চোখের বাঁধন খোলেন তাহলে আপনাকে মেরে ফেলা হবে। এ কথা বলে আমাকে ফেলে রেখে চলে যায়। সেখানে আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো মানুষ ছিল না। চোখ বাঁধা অবস্থায় ছিলাম ৪০ দিন। আমাকে যখন ধরে নিয়ে যায় তখন আমার ওজন ছিল ৯০ কেজি। যখন ছেড়ে দেয় তখন ওজন হয় ৬০ কেজি। এভাবেই আয়নাঘরের দুর্বিষহ জীবন ও কষ্টের কথা জানালেন লেক্সাস গ্রুপের চেয়ারম্যান ব্যবসায়ী বেলাল হোসেন।
২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর বেলাল হোসেনকে কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বলেন, আমাকে জোর করে একটি গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আমার সঙ্গে থাকা সব জিনিসপত্র কেড়ে নিয়ে চোখ ও হাত বেঁধে ফেলে। ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটি পর একটি জায়গায় আমাকে নামানো হয়। কোথায় নিয়ে গেল জানি না। সেখানে নিয়ে শরীরের সব কাপড় খুলে আমাকে একটা লুঙ্গি পরিয়ে দেয়। এ সময় আমার হাত ও চোখ বাঁধা ছিল।
কেন তাকে ধরা হয় এই বিষয় তিনি বলেন, কুয়াকাটায় কিছু জমি নিয়ে একজন সেনাকর্মকর্তার সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব ছিল। সে সময়ে র্যাবের তৎকালীন ডিজি বেনজীর আহমেদের সঙ্গে যোগসাজশে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে ছাড়ার আগে হুমকিও দেওয়া হয়। যদি গণমাধ্যমসহ কোথাও মুখ খুলেন, তবে তার দুটো সন্তানকে মেরে ফেলা হবে।
বেলালের বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাই। তিনি ঢাকায় থাকেন। আয়নাঘরের বর্বর নির্যাতন, প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ভয়, তওবা পড়ানোসহ অমানবিক বিভিন্ন কষ্টের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ছোট্ট কবরের সমান একটা জায়গা, চোখ-হাত বাঁধা, কোনো আলো-বাতাস নেই। রাত গভীর হলেই ঝিঁঝি পোকার ডাক। অনেকই এখানে বন্দি ছিল, তাদের কান্নার আওয়াজ ও আর্তনাদ প্রায়ই শোনা যেত।
বেলাল জানান, আমার কাছে ওরা টাকা দাবি করে। আমাকে বলে, টাকা না দিলে মাদক ও অস্ত্র দিয়ে মিডিয়ার সামনে মাদককারবারি বলে তুলে ধরা হবে। বলবে আমি মাদককারবারি, আমি অস্ত্র ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, আমার চোখ সব সময় কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা থাকত, খাবার দিলে আমি কখনোই বুঝতে পারতাম না। হাত দিলে কোনোরকমে বোঝা যেত খাবার দিয়েছে। খাবারও ছিল যতসামান্য দুটো রুটির সঙ্গে একটু ভাজি দিত। এর সঙ্গে বেশ কিছু মেডিসিন। এসব এক দিন খেলে তিন দিন ঘুমিয়ে থাকতাম। আয়নাঘরে এক দিন থাকা মানে কারাগারে এক বছর থাকার সমান। সেখানে গোসল করার কোনো সুযোগ ছিল না। প্রহরীরা সব সময় বলত চোখ খুলতে পারবে না, চোখ খুললেই মেরে ফেলব।
বেলাল আরও বলেন, আয়নাঘরে আমাকে তিন দিন অজু করিয়ে তওবা পড়ানো হয়। শেষ ইচ্ছা কী, কী খেতে ইচ্ছা করে, এসব জিজ্ঞাসা করা হয়। এছাড়া লাশ কোথায় দেবে সে বিষয়েও আমাকে প্রশ্ন করা হয়। তখন তাদের কাছে আমি জীবন ভিক্ষা চাই। পরে ১০ কোটি টাকার বিনিময়ে আমি মুক্তি পাই। আয়নাঘর থেকে বের হওয়ার পর দুই মাস চোখে দেখতে পাইনি। অপারেশন করার পর চোখে দেখতে শুরু করি। এরপর আবার হৃদরোগে আক্রান্ত হই। পরে হার্টে দুটো রিং পরানো হয়।
বেলাল মনে করেন বাংলাদেশের যত জায়গায় র্যাবের অফিস আছে সব জায়গায় তদন্ত করা উচিত। সব জায়গায় আয়নাঘর আছে। কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করে ওরা। প্রাণভয়ে যারা এতদিন মুখ খোলেননি। হাসিনা সরকারের পতনের পর তারা এখন মুখ খুলছেন, নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছেন। বেলাল হোসেন সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এ ঘটনার বিচার চান।