দেড় দশক ধরে ভারত রাখঢাক না রেখেই শেখ হাসিনার নৃশংস ও স্বৈরাচারী শাসনকে সমর্থন করেছে। দেশটিতে ২০ দিনের সরকারবিরোধী সহিংস আন্দোলন তাঁকে সেনা কার্গো বিমানে করে ভারত যেতে বাধ্য করেছে। এই আন্দোলনে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৫৪২ জনের।
বছরের পর বছর ধরে হাসিনার দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারকে অন্ধ সমর্থন দিয়ে গেছে দক্ষিণ ব্লক (ভারত)। ওই শাসনামলে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে, যা দেশটির জাতীয় বাজেটের দ্বিগুণ।
হাসিনার শাসনামলে ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার কখনোই বাংলাদেশ অথবা দেশটির জনগণকে বন্ধু বানানোর চেষ্টা করেনি। বরং হাসিনা ও আওয়ামী লীগের জন্য ভারত নিজেদের সুনাম ও জাতীয় স্বার্থ ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। যখন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের শাস্তি দিতে চেয়েছে তখন ভারত হাসিনাকে সুযোগ দিতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে তদবির চালিয়ে গেছে। দিল্লি ওয়াশিংটনকে বলেছে, আমাদের একটি কৌশলগত অংশীদার হিসেবে নিতে পারবেন না যদি না আমাদের একই ধরনের কৌশলগত ঐকমত্য থাকে।
বাংলাদেশে যেভাবে সত্যিকারের গণতন্ত্র ফিরতে পারেবাংলাদেশে যেভাবে সত্যিকারের গণতন্ত্র ফিরতে পারে
গত ১৯ জুলাই বাংলাদেশে পুলিশের গুলিতে ৭৫ জন নিহত হন। ওই দিন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এর কয়েক দিন পর গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতন হয়। ক্ষমতা নিয়ে দেশটির অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস এটিকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ হিসেবে আখ্যা দেন। এরপরেও পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেন প্রতিবেশী দেশের মানুষজন তাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠেছে সেই বিষয়টি তুলে ধরেননি।
কারণ না খুঁজে কিছু ভারতের গণমাধ্যম হাসিনার পতনের পেছনে সন্দেহভাজন হিসেবে পাকিস্তান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের নাম বলেছে। এটা সত্যিই পরিহাসের বিষয় যে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে স্নায়ুযুদ্ধ ২.০-এর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়কেই বাংলাদেশের মিত্র হিসেবে দেখা হয়। এই গণঅভ্যুত্থানে পাকিস্তানের সম্পৃক্ততাও হাস্যকর।
গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ মাথাপিছু জিডিপিতে ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে। দেশটির জনগণের গড় বয়স ২৬। যে জেন-জি প্রজন্মের নেতৃত্বে হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। ভারত ও পাকিস্তান তাদের কাছে নিতান্তই দুটি দেশ, যা নিয়ে তারা বিভিন্ন সময়ে মিম তৈরি করে থাকেন।
কিছু কিছু ভারতীয় গণমাধ্যম আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করেছে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য। এই ধরনের প্রচারণা সমগ্র উপমহাদেশে সংখ্যালঘুদের নিপীড়নের বড় ইস্যুটিকে তুচ্ছ করে তোলে।
গণমাধ্যমের মতো ভারত সরকারও বুঝতে পারছে না যে হাসিনা তাদের জন্য একটি বোঝা। এরইমধ্যে ক্ষমতাচ্যুত এই স্বৈরশাসক একাধিক অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের প্রতিবেদনে অনুযায়ী, বাংলাদেশে আন্দোলনে ৩২ জন শিশু নিহত হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে ছোট শিশুটির বয়স পাঁচ। রিয়া গোপ নামের এই হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিশুটি ছাদে খেলার সময় গুলিবিদ্ধ হয়। যার নির্দেশে এমন অমানবিক কর্মকাণ্ড হয়েছে তাঁকে আশ্রয় দেওয়া ও রক্ষা করা অসম্ভব।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো লাগছে না। হাসিনার প্রতি বছরের পর বছর সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ। তবে সাধারণ বাংলাদেশিরা ভারতকে আওয়ামী লীগ থেকে আলাদা করা কঠিন মনে করছে। হাসিনার পতনের কয়েক ঘণ্টা পরই ঢাকায় ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ করার মতো ঘটনা ঘটেছে। তবে গত সপ্তাহে ঢাকায় সীমিত আকারে ভারতের ভিসা এপ্লিকেশন সেন্টার তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে।
হাসিনাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ভারতে থাকতে দিলে বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও খারাপ হতে পারে। হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ চূড়ান্ত হলে নতুন বাংলাদেশ সরকার তাকে প্রত্যর্পণ চাইতে পারে। ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে। এর অধীনে হত্যা মামলার আসামি হাসিনাকে ফেরত চাইতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এরইমধ্যে সরকার হাসিনার বিশেষ পাসপোর্ট বাতিল করেছে। তিনি ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় এটি ব্যবহার করেছিলেন। এ বিষয়টি দিল্লিতে তার থাকার বিষয়টি আরও জটিল করে তুলেছে।
হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে ভারত হাজার হাজার তরুণকে তাঁদের থেকে বিচ্ছিন হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। সেইসঙ্গে এইসব তরুণদের চীনমুখী হওয়ার ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটি একটি বিশৃঙ্খলা যা স্পষ্টতই ভারতের অদক্ষ এবং অলস আমলাতন্ত্র নিজের ওপর নিয়ে এসেছে।
একটি সমস্যা সমাধানের জন্য বড় পদক্ষেপ হল সমস্যাটিকে স্বীকার করা। ভারতের এখনই সময় বাংলাদেশের জনগণের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার এবং তার বাংলাদেশে পুরনো বন্ধুদের কাছ থেকে লিজ নেওয়া বন্ধ করার। ভারতকে বাংলাদেশে নতুন বন্ধু খুঁজে বের করতে হবে। তাদের পুরোনো নীতি ব্যর্থ হয়েছে, এটি তাদের বুঝতে হবে। এটিও বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশে তার পুরনো বন্ধুকে ঘৃণার চোখে দেখা হচ্ছে।
এর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টাতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতের সাহায্য আমাদের ইতিহাসের অংশ। কিন্তু ৫৪ বছর আগে যে সাহায্য দেওয়া হয়েছিল তা বাংলাদেশকে ঋণী মনে করার জন্য যথেষ্ট নয়।
যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ স্বাধীন করেছে। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের কলোনি না। ওয়াশিংটন, ফ্রান্স, ইতালি বা জার্মানিতে গণতন্ত্রকে গলা টিপে দেওয়ার চেষ্টা করে না। ভারত যদি একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি হতে চায়, তার পররাষ্ট্রনীতিকে আমেরিকার মতো ভূমিকা পালন করতে হবে। সাধারণ বাংলাদেশিরা ভারতের শত্রু নয়। সমস্যাটা হচ্ছে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের নীতি।
লেখক: বাংলাদেশি সাংবাদিক। তিনি ‘দ্য নিউ অ্যান্থেম: দ্য সাবকন্টিনেন্ট ইন ইটস ওয়ার্ডস’ (ট্রাঙ্কেবার; দিল্লি) সংকলনের সম্পাদক
নিবন্ধটি দ্য ওয়্যার থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: ইয়াসিন আরাফাত